নওগাঁ কিসের জন্য বিখ্যাত তা জেনে নিন

 ধান কিভাবে চাষ করা হয় তা জেনে নিনধান উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ হলো নওগাঁ জেলা। এছাড়াও আম এই প্রধান অর্থকরী ফল হয়ে আবির্ভূত হয়েছে গত এক বছরে। এই জেলার সীমান্তবর্তী সাপাহার, পোরশা, পত্নীতলা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় বিপুল প্রমাণ আমের বাগান রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশ আম উৎপাদনে শীর্ষ স্থান দখল করে এই জেলা।
নওগাঁ কিসের জন্য বিখ্যাত তা জেনে নিন
নওগাঁ কিসের জন্য বিখ্যাত তা জেনে নিন

নওগাঁ জেলায় কতটি গ্রাম আছে 

৩৪৩৫.৬৫ বর্গ কিলোমিটার (১৩২৬.৫১ বর্গ মাইল)। রাজশাহী জেলার অধীনে নওগাঁ মহকুমা, ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে একটি জেলায় পরিণত হয়। এটি ২টি পৌরসভা, ১১টি উপজেলা, ১৮টি ওয়ার্ড, ৭৪টি মহল্লা, ৯৯টি ইউনিয়ন পরিষদ এবং ২৭৯৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।

নওগাঁ জেলার বিখ্যাত স্থান

নওগাঁ জেলার দর্শনীয় জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হলো পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, বলিহার রাজবাড়ী, কুসুম্বা মসজিদ, রঘুনাথ মন্দির, রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ী, আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান, দিব্যক জয়স্তম্ভ, ভীমের পানটি ইত্যাদি

দিব্যক জয়স্তম্ভ

নওগাঁ জেলা থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে পত্নীতলা উপজেলার দিবর দীঘির মাঝখানে বাঙ্গালী আভিজাত্যের প্রতীক দিব্যক জয়স্তম্ভ (Dibar Jayastambha) বা দিবর স্তম্ভ অবস্থিত। গোলাকৃতি দিবর দীঘিতে অবস্থিত আটকোণ বিশিষ্ট গ্রানাইড পাথরের এই জয়স্তম্ভটির মোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি, যার ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি পানির নিচে এবং ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি পানির উপরে দৃশ্যমান।


স্তম্ভতির প্রতিটি কোণের পরিধি ১ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। দিব্যক জয়স্তম্ভের উপরের অংশটি খাঁজ কাটা মুকুটাকৃতির নানা কারুকার্যে সুশোভিত। চারপাশের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন এই জয়স্তম্ভটি স্থানীয়দের কাছে একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ী

নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলায় পতিসর গ্রামে নাগর নদীর তীরে অবস্থিত রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ী (Rabindra Kachari Bari) বাংলাদেশের একটি অন্যতম সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। নওগাঁ শহর থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার।

১৮৩০ সালে রবি ঠাকুরের পিতামহ ও জোড়াঠাকুর পরিবারের অন্যতম সদস্য দ্বারকানাথ ঠাকুর এই অঞ্চলে আগমন করেন। পরবর্তীতে ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম কালিগ্রাম পরগনার জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে আসেন।

প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত পতিসর রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ীর সামনে সিংহ দুয়ার, প্রশস্থ আঙ্গিনা, দোতালা কুঠিবাড়ি এবং কুঠিবাড়িকে ঘিরে থাকা বেশকিছু ভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।

নান্দনিক প্রবেশ পথ দিয়ে সামনে আগালেই মূল ভবনের সামনে নজরে পড়ে কংক্রিটের তৈরী রবি ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি ও মার্বেল পাথরে খোদিত রবীন্দ্র রচনার কিছু কথা।

রবীন্দ্র কাচারি বাড়ির ভিতরে বিভিন্ন সংরক্ষিত নিদর্শনের মধ্যে আছে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, কবির স্বহস্তে লিখিত চিঠি, কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি ও আসবাপত্র প্রভৃতি। এছাড়া কুঠিবাড়ির সামনে আছে রবীন্দ্র সরোবর, দীঘি ও কালিগ্রাম রবীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউট।

বলিহার রাজবাড়ি

নওগাঁ জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বলিহার ইউনিয়নে প্রাচীন বলিহার রাজবাড়ি (Balihar Rajbari) অবস্থিত। সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক জায়গির লাভ করে বলিহার জমিদার এই রাজবাড়ি তৈরী করেন। যা বর্তমানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে সুপরিচিত।

দোতালা জমিদার বাড়ির সামনে আছে বিশালাকারের তোরণ এবং ভেতরে আছে নাটমন্দির, রাজ রাজেশ্বরী মন্দির, জোড়া শিব মন্দির ও ২টি শিবলিঙ্গ। মন্দিরের দেয়ালে থাকা মূল্যবান রিলিফের কারুকার্য মন্দিরের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে।

১৮২৩ সালে বলিহারের জমিদার রাজেন্দ্র লোকান্তরিত হবার পূর্বে বলিহার রাজবাড়ির দূর্গা মন্দিরে রাজ রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও প্রাচীনকালে মন্দির ভবনে অবস্থিত প্রতিটি কক্ষকে এক একটি মন্দির বলে ধারণা করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন জমিদার রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বলিহারের জমিদারিত্বের দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ দেশ বিভাগের সময় বলিহারের জমিদার রাজা বিমেলেন্দু রায় ভারতে চলে গেলে রাজ পরিবারের অন্যান্য কর্মচারীরা বলিহার রাজবাড়ী দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।

একসময় বলিহার জমিদারীর অধীনে ৩৩০টি দীঘি/পুকুর থাকলেও বর্তমানে এর মাত্র কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ীর বিভিন্ন নিদর্শন, আসবাপত্র সহ অনেক মূল্যবান সামগ্রী দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়।

কিছুদিন আগেও বলিহার রাজবাড়ির একটি ভবন স্থানীয় স্কুলের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে এটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। তবে রাজবাড়ীর ভিতরের দেবালয়ে নিয়মিয় পূজা অর্চনা করা হয়ে থাকে।

পাহাড়পুর জাদুঘর

নওগাঁ জেলায় অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাছে ষাটের দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পাহাড়পুর জাদুঘর (Paharpur Bihar Museum) প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নওগাঁ থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত এই জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো আগত দর্শনার্থীদের কাছে প্রধান আকর্ষণ।
১৯৯৮ সালে পাহাড়পুর বিহার জাদুঘরের পুরাতন ভবন ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়।

৪ গ্যালারি বিশিষ্ট এই জাদুঘরে পাহাড়পুর বিহার এবং আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো রাখা হয়েছে। পাহাড়পুর জাদুঘরে সংরক্ষিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে ব্রোঞ্জের তৈরি বৌদ্ধের আবক্ষ মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, অলংকৃত ইট, পাথরের মূর্তি ও পোড়ামাটির তৈজসপত্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আলতাদীঘি

নওগাঁ জেলাস্থ ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে আলতাদীঘি (Alta Dighi) অবস্থিত। ধামইরহাট হতে গ্রামের আধা পাকা রাস্তা ধরে যতই এগিয়ে যাওয়া যায় ততই গাছগাছালি ঘেরা সবুজ প্রকৃতির মুগ্ধতাকে উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সরকারিভাবে সংরক্ষিত শালবন এবং লাল মাটির পাহাড়ি এলাকার মতো বনের উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটলে গ্রাম বাংলার বিচিত্র রূপের সৌন্দর্য আহরণ করতে পারবেন।

আলতাদীঘির নামানুসারে আলতাদীঘি গ্রামের নামকরণ করা হয়। প্রায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪০০ মিটার প্রস্থের প্রাচীন দীঘিটিকে বৌদ্ধ যুগের কীর্তি হিসাবে মনে করা হয়। কারণ দীঘির কাছেই পাল শাসনামলে নির্মিত জগদ্দল বৌদ্ধ বিহার দেখতে পাওয়া যায়।

এই বিহারে বিষ্ণু, শিব এবং কষ্টিপাথরের কারুকার্যখচিত নারীর মুখমণ্ডলের প্রতিকৃতি রক্ষিত আছে। সুবিশাল আলতাদীঘিতে আছে প্রায় ৫৫ প্রজাতির দেশীয় মাছ এবং ১৪ হাজার প্রজাতির বিভিন্ন জলজ প্রাণীর বসবাস।

আলতাদীঘির উত্তর পাড় ঘেঁষে রয়েছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে বিএসএফের কর্মতৎপরতা দেখা যায়। শীতকালে আলতাদীঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এছাড়া দাঁড়টানা নৌকায় চাইলে নৌভ্রমণও করতে পারবেন। আলতাদীঘি সংলগ্ন গ্রামের বেশিরভাগ ঘরগুলো মাটির তৈরী।

একতলা, দোতলা ঘর দেখতে দেখতে গ্রামের ভেতরটা ঘুরে যেতে পারেন। গ্রামের আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবনধারা আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও বৈচিত্র্যময় করবে। বর্তমানে আলতাদীঘিকে কেন্দ্র করে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান (Altadighi National Park) গড়ে তোলা হয়েছে

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (Paharpur Buddhist Bihar) বা সোমপুর মহাবিহার (Somapura Mahavihara) নামে পরিচিত বৌদ্ধ বিহারটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন স্থাপনা। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

বিখ্যাত পালবংশের ২য় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব ৯ম শতকে এই বৌদ্ধ বিহার তৈরি করেন। স্যার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার প্রায় ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। তৎকালীন সময়ে তিব্বত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মায়ানমার থেকেও বৌদ্ধরা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে ধর্মচর্চা ও জ্ঞান অর্জন করতে ছুটে আসতেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। বিহারটিতে সর্বমোট ১৭৭ টি ঘরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। বিহারের ঠিক মধ্যখানে শোভা বাড়িয়েছে একটি মন্দির, যার দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫০ ফুট এবং মন্দিরটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু।

মন্দিরের বাইরের দেয়ালে বুদ্ধ ও হিন্দুদের দেবী মূর্তি এবং পোড়া মাটির বেশকিছু ফলক স্থান পেয়েছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মূল বেষ্টনী প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনীর ভেতরে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।

কুসুম্বা মসজিদ

কুসুম্বা মসজিদ (Kusumba Mosque) নওগাঁ জেলায় অবস্থিত প্রায় সাড়ে চারশত বছর পুরনো একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলাধীন ৮ নং কুশুম্বা ইউনিয়নের কুশুম্বা গ্রামে কুসুম্বা মসজিদের অবস্থান।

নওগাঁ থেকে মসজিদটির দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এবং মান্দা উপজেলা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। সুলতানি আমলের সাক্ষী কুসুম্বা মসজিদ এর ছবি বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত আছে।

কুসুম্বা মসজিদকে নওগাঁ জেলার ইতিহাস এবং মুসলিম স্থাপত্য শিল্পরীতির অনবদ্য নিদর্শন হিসাবে গন্য করা হয়। এ অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর প্রথম যুগের ঐতিহ্যবাহী মসজিদ দেখতে সারাদেশ থেকে অসংখ্য লোকের সমাগম ঘটে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ব্রোক্লিন৬৯ এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url